বই পড়া প্রমথ চৌধুরী। বাংলা ১ম পত্র বই পড়া অনুচ্ছেদ

বই পড়া গল্প টি এই পোস্টে দেওয়া হয়েছে। এস এস সি বাংলা ১ম পত্রের গদ্যর একটি অংশ এই গল্পটি। গল্পটি লিখেছেন কবি প্রমথ চৌধুরী। তিনি অনেক কবিতাও লিখেছেন। গল্পটির প্রধান উদ্দেশ্য হলে মানব সমাজে বই নিয়ে উৎসাহিত করা। আমাদের পাঠচর্চার অনভ্যাস যে শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটির জন্য ঘটছে তা এই গল্পে ফুটিয়ে তুলেছে। গল্পটির মাধ্যমেজাতির মানসিক বিকাশ ও সমৃদ্ধিতে বই পড়া, জ্ঞান ও সাহিত্যচর্চার বিকাশ ঘোটায়। নিচে সম্পূর্ণ গল্প টি দেওয়া আছে পড়ে নিন।

বই পড়া

এই অংশে গল্প টি দেওয়া আছে। সম্পূর্ণ প্রবন্ধ টি আমার এই পোস্ট থেকে পড়তে পারবেন। প্রমথ চৌধুরীর এই গল্প টি নবম-দশম শ্রেণির বই থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। গল্প টি পিডিএফ ফাইলে সংগ্রহ করতে পারবেন। গল্প টি পড়ুন এখান থেকে।

বই পড়া প্রমথ চৌধুরী

বই পড়া শখটা মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ শখ হলেও আমি কাউকে শখ হিসেবে বই পড়তে পরামর্শ দিতে চাইনে। প্রথমত সে পরামর্শ কেউ গ্রাহ্য করবেন না, কেননা আমরা জাত হিসেবে শৌখিন নই। দ্বিতীয়ত অনেকে তা কুপরামর্শ মনে করবেন কেননা আমাদের এখন ঠিক শখ করবার সময় নয়। আমাদের এই রােগ-শােক, দুঃখ-দারিদ্র্যের দেশে সুন্দর জীবন ধারণ করাই যখন হয়েছে প্রধান সমস্যা, তখন সেই জীবনকেই সুন্দর করা, মহৎ করার প্রস্তাব অনেকের কাছে নিরর্থক এবং নির্মমও ঠেকবে। আমরা সাহিত্যের রস উপভােগ করতে প্রস্তুত নই; কিন্তু শিক্ষার ফল লাভের জন্য আমরা সকলে উদ্বাহু।

আমাদের বিশ্বাস, শিক্ষা আমাদের গায়ের জ্বালা ও চোখের জল দুই-ই দূর করবে। এ আশা সম্ভবত দুরাশা; কিন্তু তা হলেও আমরা তা ত্যাগ করতে পারি নে কেননা আমাদের উদ্ধারের জন্য কোনাে সদুপায় আমরা চোখের সুমুখে দেখতে পাইনে। শিক্ষার মাহাত্মে আমিও বিশ্বাস করি এবং যিনিই যাই বলুন, সাহিত্যচর্চা যে শিক্ষার সর্বপ্রধান অঙ্গ সে বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই। লােকে যে তা সন্দেহ করে, তার কারণ এ শিক্ষার ফল হাতে হাতে পাওয়া যায় না, অর্থাৎ তার কোনাে নগদ বাজারদর নেই। এই কারণে ডেমােক্রেসি সাহিত্যের সার্থকতা বােঝে না, বােঝে শুধু অর্থের সার্থকতা।

ডেমােক্রেসির গুরুরা চেয়েছিলেন সকলকে সমান করতে কিন্তু তাদের শিষ্যরা তাদের কথা উলটো বুঝে প্রতি জনেই হতে চায় বড়ােমানুষ। একটি বিশিষ্ট অভিজাত সভ্যতার উত্তরাধিকারী হয়েও ইংরেজি সভ্যতার সংস্পর্শে এসে আমরা ডেমােক্রেসির গুণগুলাে আয়ত্ত করতে না পেরে তার দোষগুলাে আত্মসাৎ করেছি। এর কারণও স্পষ্ট। ব্যাধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়। আমাদের শিক্ষিত সমাজের লােলুপদৃষ্টি আজ অর্থের উপরেই পড়ে রয়েছে।

সুতরাং সাহিত্যচর্চার সুফল সম্বন্ধে অনেকেই সন্দিহান। যারা হাজারখানা ল-রিপাের্ট কেনেন, তারা একখানা কাব্যগ্রন্থও কিনতে প্রস্তুত নন; কেননা তাতে ব্যবসার কোনাে সুসার নেই। নজির না আউড়ে কবিতা আবৃত্তি করলে মামলা যে হারতে হবে সে তাে জানা কথা। কিন্তু যে কথা জজে শােনে না, তার যে কোনাে মূল্য নেই, এইটেই হচ্ছে পেশাদারদের মহাভ্রান্তি । জ্ঞানের ভাণ্ডার যে ধনের ভাণ্ডার নয়, এ সত্য তাে প্রত্যক্ষ ।

কিন্তু সমান প্রত্যক্ষ না হলেও সমান সত্য যে, এ যুগে যে জাতির জ্ঞানের ভাণ্ডার শূন্য সে জাতির ধনের ভাঁড়েও ভবানী। তারপর যে জাতি মনে বড়াে নয়, সে জাতি জ্ঞানেও বড়াে নয়; কেননা ধনের সৃষ্টি যেমন জ্ঞানসাপেক্ষ তেমনি জ্ঞানের সৃষ্টি ও মন সাপেক্ষ এবং মানুষের মনকে সরল, সচল, সরাগ ও সমৃদ্ধ করার ভার আজকের দিনে সাহিত্যের উপরও ন্যস্ত হয়েছে। কেননা মানুষের দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মনীতি, অনুরাগ-বিরাগ, আশা-নৈরাশ্য, তার ? অন্তরের স্বপ্ন ও সত্য, এই সকলের সমবায়ে সাহিত্যের জন্ম ।

অপরাপর শাস্ত্রের ভিতর যা আছে, সে সব হচ্ছে মানুষের মনের ভগ্নাংশ; তার পুরাে মনটার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় শুধু সাহিত্যে। দর্শন বিজ্ঞান ইত্যাদি হচ্ছে মনগঙ্গার তােলা জল, তার পূর্ণ স্রোত আবহমানকাল সাহিত্যের ভেতরই সােল্লাসে সবেগে বয়ে চলেছে এবং সেই গঙ্গাতে অবগাহন করেই আমরা আমাদের সকল পাপমুক্ত হব। অতএব দাঁড়াল এই যে, আমাদের বই পড়তে হবে, কেননা বই পড়া ছাড়া সাহিত্যচর্চার উপায়ান্তর নেই।

ধর্মের চর্চা চাইকি মন্দিরের বাইরেও করা চলে, দর্শনের চর্চা গুহায়, নীতির চর্চা ঘরে এবং বিজ্ঞানের চর্চা জাদুঘরে; কিন্তু সাহিত্যের চর্চার জন্য চাই লাইব্রেরি; ও-চর্চা মানুষে কারখানাতেও করতে পারে না; চিড়িয়াখানাতেও নয়। এইসব কথা যদি সত্য হয়, তাহলে আমাদের মানতেই হবে যে, সাহিত্যের মধ্যেই আমাদের জাত মানুষ হবে।

সেইজন্য আমরা যত বেশি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করব, দেশের তত বেশি উপকার হবে। আমাদের মনে হয়, এ দেশে লাইব্রেরির সার্থকতা হাসপাতালের চাইতে কিছু কম নয় এবং স্কুল কলেজের চাইতে একটু বেশি। একথা শুনে অনেকে চমকে উঠবেন, কেউ কেউ আবার হেসেও উঠবেন; কিন্তু আমি জানি, আমি রসিকতাও করছি নে, অদ্ভুত কথাও বলছি নে; যদিও এ বিষয়ে লােকমত যে আমার মতের সমরেখায় চলে না, সে বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ সচেতন।

অতএব আমার কথার আমি কৈফিয়ত দিতে বাধ্য। আমার বক্তব্য আমি আপনাদের কাছে নিবেদন করছি, তার সত্য মিথ্যার-বিচার আপনারা করবেন। সে বিচারে আমার কথা যদি না টেকে, তা হলে রসিকতা হিসেবেই গ্রাহ্য করবেন।
আমার বিশ্বাস, শিক্ষা কেউ কাউকে দিতে পারে না। সুশিক্ষিত লােক মাত্রই স্বশিক্ষিত। আজকের বাজারে বিদ্যার দাতার অভাব নেই। এমনকি, এ ক্ষেত্রে দাতা কর্ণেরও অভাব নেই; এবং আমরা আমাদের ছেলেদের তাদের দ্বারস্থ করেই নিশ্চিত থাকি, এই বিশ্বাসে যে, সেখান থেকে তারা এতটা বিদ্যার ধন লাভ করে ফিরে আসবে, যার সুদে তার বাকি জীবন আরামে কাটিয়ে দিতে পারবে।

কিন্তু এ বিশ্বাস নিতান্ত অমূলক। মনােরাজ্যেও দান গ্রহণসাপেক্ষ, অথচ আমরা দাতার মুখ চেয়ে গ্রহীতার কথাটা একেবারেই ভুলে যাই। এ সত্য ভুলে না গেলে আমরা বুঝতুম যে, শিক্ষকের সার্থকতা শিক্ষাদান করায় নয়, কিন্তু ছাত্রকে তা অর্জন করতে সক্ষম করায়। শিক্ষক ছাত্রকে শিক্ষার পথ দেখিয়ে দিতে পারেন, তার কৌতূহল উদ্রেক করতে পারেন, তার বুদ্ধিবৃত্তিকে জাগ্রত করতে পারেন, মনােরাজ্যের ঐশ্বর্যের সন্ধান দিতে পারেন, তার জ্ঞানপিপাসাকে জ্বলন্ত করতে পারেন, এর বেশি আর কিছু পারেন না।

যিনি যথার্থ গুরু, তিনি শিষ্যের আত্মাকে উদ্ববাধিত করেন এবং তার অন্তর্নিহিত সকল প্রচ্ছন্ন শক্তিকে মুক্ত এবং ব্যক্ত করে তােলেন। সেই শক্তির বলে সে নিজের মন নিজে গড়ে তােলে, নিজের অভিমতবিদ্যা নিজে অর্জন করে বিদ্যার সাধনা শিষ্যকে নিজে করতে হয়। গুরু উত্তরসাধক মাত্র। আমাদের স্কুল-কলেজের শিক্ষার পদ্ধতি ঠিক উলটো। সেখানে ছেলেদের বিদ্যে গেলানাে হয়, তারা তা জীর্ণ করতে পারুক আর নাই পারুক। এর ফলে ছেলেরা শারীরিক ও মানসিক মন্দাগ্নিতে জীর্ণশীর্ণ হয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসে।

একটা জানাশােনা উদাহরণের সাহায্যে ব্যাপারটা পরিষ্কার করা যাক। আমাদের সমাজে এমন অনেক মা আছেন, যাঁরা শিশু সন্তানকে ক্রমান্বয়ে ওঁ গরুর দুধ গেলানােটাই শিশুর স্বাস্থ্যরক্ষার ও বলবৃদ্ধির সর্বপ্রধান উপায় মনে করেন। গােদুগ্ধ অবশ্য অতিশয় উপাদেয় পদার্থ, কিন্তু তার উপকারিতা যে ভােক্তার জীর্ণ করবার শক্তির উপর নির্ভর করে এ জ্ঞান ও শ্রেণির মাতৃকুলের নেই।

তাদের বিশ্বাস ও-বস্তু পেটে গেলেই উপকার হবে। কাজেই শিশু যদি তা গিলতে আপত্তি করে তা হলে সে যে ব্যাদড়া ছেলে, সে বিষয়ে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে না। অতএব তখন তাকে ধরে-বেঁধে জোর জবরদস্তি করে দুধ খাওয়ানাের ব্যবস্থা করা হয়। শেষটায় সে যখন এই দুগ্ধপান ক্রিয়া হতে অব্যাহতি লাভ করবার জন্য মাথা নাড়তে, হাত-পা ছুড়তে শুরু করে, তখন স্নেহময়ী মাতা বলেন ‘আমার মাথা খাও, মরামুখ দেখ, এই ঢোেক, আর এক ঢােক, আর এক ঢােক ইত্যাদি।

মাতার উদ্দেশ্য যে খুব সাধু, সে বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই, কিন্তু এ বিষয়েও কোনাে সন্দেহ নেই যে, উক্ত বলা কওয়ার ফলে মা শুধু ছেলের যকৃতের মাথা খান এবং ঢােকের পর ঢােকে তার মরামুখ দেখবার সম্ভাবনা বাড়িয়ে চলেন। আমাদের স্কুল-কলেজের শিক্ষা পদ্ধতিটাও ঐ একই ধরনের। এর ফলে কত ছেলের সুস্থ সরল মন যে ইনফ্যান্টাইল লিভারে গতাসু হচ্ছে তা বলা কঠিন। কেননা দেহের মৃত্যুর রেজিস্টারি রাখা হয়, আত্মার মৃত্যুর হয় না।

আমরা কিন্তু এই আত্মার অপমৃত্যুতে ভীত হওয়া দূরে থাক, উফুল্ল হয়ে উঠি। আমরা ভাবি দেশে যত ছেলে পাশ হচ্ছে তত শিক্ষার বিস্তার হচ্ছে। পাশ করা ও শিক্ষিত হওয়া এক বস্তু নয়, এ সত্য স্বীকার করতে আমরা কুণ্ঠিত হই। শিক্ষা-শাস্ত্রের একজন জগদৃবিখ্যাত ফরাসি শাস্ত্রী বলেছেন যে, এক সময়ে ফরাসি দেশে শিক্ষা-পদ্ধতি এতই বেয়াড়া ছিল যে, সে যুগে France was saved by her idlers ; অর্থাৎ যারা পাশ করতে পারেনি বা চায় নি তারাই ফ্রান্সকে রক্ষা করেছে। এর কারণ, হয় তাদের মনের বল ছিল বলে কলেজের শিক্ষাকে তারা প্রত্যাখ্যান করেছিল, নয় সে শিক্ষা প্রত্যাখ্যান করেছিল বলেই তাদের মনের বল বজায় ছিল।

তাই এই স্কুল-পালানাে ছেলেদের দল থেকে সে যুগের ফ্রান্সের যত কৃতকর্মা লােকের আবির্ভাব হয়েছিল।
সে যুগে ফ্রান্সে কী রকম শিক্ষা দেওয়া হতাে তা আমার জানা নেই। তবুও আমি জোর করে বলতে পারি যে, এ যুগে আমাদের স্কুল কলেজে শিক্ষার যে রীতি চলছে, তার চাইতে সে শিক্ষাপদ্ধতি কখনােই নিকৃষ্ট ছিল না। সকলেই জানেন যে, বিদ্যালয়ে মাস্টার মহাশয়েরা নােট দেন এবং সেই নােট মুখস্থ করে ছেলেরা হয় পাশ। এর জুড়ি আর একটি ব্যাপারও আমাদের দেশে দেখা যায় ।

এদেশে একদল বাজিকর আছে, যারা বন্দুকের গুলি থেকে আরম্ভ করে উত্তরােত্তর কামানের গােলা পর্যন্ত গলাধঃকরণ করে। তারপর একে একে সবগুলাে উগলে দেয়। এর ভেতর যে অসাধারণ কৌশল আছে, সে বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই। কিন্তু এই গেলা আর ওগলানাে দর্শকের কাছে তামাশা হলেও বাজিকরের কাছে তা প্রাণান্ত ব্যাপার । ও কারদানি করা তার পক্ষে যেমন কষ্টসাধ্য, তেমনি অপকারী। বলা বাহুল্য, সে বেচারা লােহার গােলাগুলাের এক কণাও জীর্ণ করতে পারে না।

আমাদের ছেলেরাও তেমনি নােট নামক গুরুদত্ত নানা আকারের ও নানা প্রকারের গােলাগুলাে বিদ্যালয়ে গলাধঃকরণ করে পরীক্ষালয়ে তা উদ্‌গিরণ করে দেয়। এ জন্য সমাজ তাদের বাহবা দেয় দিক, কিন্তু মনে যেন না ভাবে যে, এতে জাতির প্রাণশক্তি বাড়ছে। স্কুল-কলেজে শিক্ষা যে অনেকাংশে ব্যর্থ সে বিষয়ে প্রায় অধিকাংশ লােকই একমত। আমি বলি, শুধু ব্যর্থ নয়, অনেক স্থলে মারাত্মক। কেননা আমাদের স্কুল-কলেজের ছেলেদের স্বশিক্ষিত হবার সে সুযােগ দেয় না, শুধু তাই নয়, স্বশিক্ষিত হবার শক্তি পর্যন্ত নষ্ট করে।

আমাদের শিক্ষাযন্ত্রের মধ্যে যে যুবক নিষ্পেষিত হয়ে বেরিয়ে আসে, ? তার আপনার বলতে আর বেশি কিছু থাকে না, যদি না তার প্রাণ অত্যন্ত কড়া হয়। সৌভাগ্যের বিষয়, এই ক্ষীণপ্রাণ জাতির মধ্যেও জনকতক এমন কঠিন প্রাণের লােক আছে, এহেন শিক্ষাপদ্ধতিও তাদের মনকে জখম করলেও একেবারে বন্ধ করতে পারে না। আমি লাইব্রেরিকে স্কুল-কলেজের ওপরে স্থান দিই এই কারণে যে, এ স্থলে লােকে স্বেচ্ছায় স্বাচ্ছন্দচিত্তে স্বশিক্ষিত হবার সুযােগ পায়। প্রতিটি লােক তার স্বীয় শক্তি ও রুচি অনুসারে নিজের মনকে নিজের চেষ্টায় আত্মার রাজ্যে জ্ঞানের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।\

স্কুল কলেজ বর্তমানে আমাদের যে অপকার করছে সে অপকারের প্রতিকারের জন্য শুধু নগরে নগরে নয়, গ্রামে গ্রামে লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠা করা কর্তব্য। আমি পূর্বে বলেছি যে, লাইব্রেরি হাসপাতালের চাইতে কম উপকারী নয়, তার কারণ আমাদের শিক্ষার বর্তমান অবস্থায় লাইব্রেরি হচ্ছে একরকম মনের হাসপাতাল।

অতঃপর আপনারা জিজ্ঞাসা করতে পারেন যে, বই পড়ার পক্ষ নিয়ে এ ওকালতি করবার, বিশেষত প্রাচীন নজির দেখাবার কী প্রয়ােজন ছিল? বই পড়া যে ভালাে, তা কে না মানে? আমার উত্তরসকলে মুখে মানলেও কাজে মানে না। মুসলমান ধর্মে মানবজাতি দুই ভাগে বিভক্ত। যারা কেতাবি, আর এক যারা তা নয়। বাংলায় শিক্ষিত সমাজ যে পূর্বদলভুক্ত নয়, একথা নির্ভয়ে বলা যায় না; আমাদের শিক্ষিত সম্প্রদায় মােটের ওপর বাধ্য না হলে বই স্পর্শ করেন না।

ছেলেরা যে নােট পড়ে এবং ছেলের বাপেরা যে নজির পড়েন, দুই-ই বাধ্য হয়ে, অর্থাৎ পেটের দায়ে। সেইজন্য সাহিত্যচর্চা দেশে একরকম নেই বললেই হয়; কেননা, সাহিত্য সাক্ষাৎভাবে উদরপূর্তির কাজে লাগে না। বাধ্য হয়ে বই পড়ায় আমরা এতটা অভ্যস্ত হয়েছি যে, কেউ স্বেচ্ছায় বই পড়লে আমরা তাকে নিষ্কর্মার দলেই ফেলে দিই; অথচ একথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না, যে জিনিস স্বেচ্ছায় করা যায়, তাতে মানুষের মনের সন্তোষ নেই।

একমাত্র উদরপূর্তিতে মানুষের সম্পূর্ণ মনস্তুষ্টি হয়। একথা আমরা সকলেই জানি যে,উদরের দাবি রক্ষা না করলে মানুষের দেহ বাঁচে না; কিন্তু একথা আমরা সকলে মানিনে যে, মনের দাবি রক্ষা না করলে মানুষের আত্মা বাঁচে না। দেহরক্ষা অবশ্য সকলেরই কর্তব্য কিন্তু আত্মরক্ষাও অকর্তব্য নয়। মানবের ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা রয়েছে যে মানুষের প্রাণ মনের সম্পর্ক যত হারায় ততই তা দুর্বল হয়ে পড়ে।

মনকে সজাগ ও সবল রাখতে না পারলে জাতির প্রাণ যথার্থ স্ফুর্তিলাভ করে না; তারপর যে জাতি যত নিরানন্দ সে জাতি তত নির্জীব। একমাত্র আনন্দের স্পর্শেই মানুষের মনপ্রাণ সজীব, সতেজ ও সরাগ হয়ে ওঠে। সুতরাং সাহিত্যচর্চার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হওয়ার অর্থ হচ্ছে, জাতির জীবনীশক্তির হ্রাস করা। অতএব, কোনাে নীতির অনুসারেই তা কর্তব্য হতে পারে না। অর্থনীতিরও নয়, ধর্মনীতিরও নয়।

কাব্যামৃতে যে আমাদের অরুচি ধরেছে সে অবশ্য আমাদের দোষ নয়, আমাদের শিক্ষার দোষ। যার আনন্দ নেই সে নির্জীব একথা যেমন সত্য, যে নির্জীব তারও আনন্দ নেই, সে কথাও তেমনি সত্য। আমাদের শিক্ষাই আমাদের নির্জীব করেছে। জাতীয় আত্মরক্ষার জন্য এ শিক্ষার উলটো টান যে বই পড়া আমাদের টানতে হবে, এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ।

এই বিশ্বাসের বলেই আমি স্বেচ্ছায় সাহিত্যচর্চার সপক্ষে এত বাক্য ব্যয় করলুম। সে বাক্যে আপনাদের মনােরঞ্জন করতে সক্ষম হয়েছি কিনা জানিনে। সম্ভবত হইনি। কেননা, আমাদের দুরবস্থার কথা যখন স্মরণ করি, তখন খালি কোমল সুরে আলাপ করা আর চলে না; মনের আক্ষেপ প্রকাশ করতে মাঝে মাঝেই কড়ি লাগাতে হয়।

বই পড়া শব্দার্থ ও টীকা

শৌখিন- রুচিবান।

উদ্বাহ- ঊর্ধ্ববাহু। আহ্লাদে হাত ওঠানাে। ডেমােক্রেসিগণতন্ত্র ।

সন্দিহান- সন্দেহযুক্ত। সুসার- প্রাচুর্য, সচ্ছলতা, সুবিধা।

জজ- বিচারক। ভড়েও ভবানীরিক্ত, শূন্য।

আবহমানকাল- চিরকাল।

সােম্লাসে- আনন্দে।

অবগাহন- সর্বাঙ্গ ডুবিয়ে গােসল।

উপায়ান্তর- অন্য কোনাে উপায়।

স্বশিক্ষিত- নিজে নিজে শিক্ষিত।

প্রচ্ছন্ন গোেপন। জীর্ণ- হজম।

অব্যাহতি- মুক্তি। গতা- মৃত ।

গলাধঃকরণ- গিলে ফেলা।

কারদানি- বাহাদুরি। উদরপূর্তিপেট ভরানাে।

ডেমােক্রেটিক- গণতান্ত্রিক।

দাতাকর্ণ- মহাভারতের বিশিষ্ট চরিত্র,

কুন্তীপুত্র; দানের জন্য প্রবাদতুল্য মানুষ।

কেতাবি- কেতাব অনুসরণ করে চলে যারা।

বই পড়া অনুচ্ছেদ রচনা

বই পড়া’ প্রবন্ধটি প্রমথ চৌধুরীর প্রবন্ধ সংগ্রহ থেকে নির্বাচন করা হয়েছে। একটি লাইব্রেরির বার্ষিক সভায় প্রবন্ধটি পঠিত হয়েছিল। আমাদের পাঠচর্চার অনভ্যাস যে শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটির জন্য ঘটছে তা সহজেই লক্ষণীয়। আর্থিক অনটনের কারণে অর্থকরী নয় এমন সবকিছুই এদেশে অনর্থক বলে বিবেচনা করা হয়। সেজন্য বই পড়ার প্রতি লােকের অনীহা দেখা যায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে লব্ধ শিক্ষা পূর্ণাঙ্গ নয় বলে ব্যাপকভাবে বই পড়া দরকার। কারণ সুশিক্ষিত লােক মাত্রই স্বশিক্ষিত। যথার্থ শিক্ষিত হতে হলে মনের প্রসার দরকার।

তার জন্য বই পড়ার অভ্যাস বাড়াতে হবে। এর জন্য লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার প্রয়ােজন। বাধ্য না হলে লােকে বই পড়ে না। লাইব্রেরিতে লােকে নিজের পছন্দ অনুযায়ী বই পড়ে যথার্থ শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারে। প্রগতিশীল জগতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য সাহিত্যচর্চা করা আবশ্যক বলে লেখক মনে করেন। বই পড়া’ প্রবন্ধে প্রমথ চৌধুরী বই পড়ার গুরুত্ব ও তাৎপর্য উপস্থাপন করেছেন। প্রবন্ধটি এই শিক্ষাই দেয় যে, জাতির মানসিক বিকাশ ও সমৃদ্ধিতে বই পড়া, জ্ঞান ও সাহিত্যচর্চার কোনাে বিকল্প নেই।

শেষ কথা

পোস্ট টি পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আশা করছি এই পোস্ট টি আপনাদের ভালো লেগেছে এবং এখান থেকে বই পড়া প্রমথ চৌধুরী সংগ্রহ করতে পেরেছেন। এই রকম আরও ভালো ভালো পোস্ট পেতে আমাদের সাথেই থাকবেন। এস এস সি শিক্ষা সংক্রান্ত আরও পোস্ট এই ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে।

আরও দেখুনঃ

ফুলের বিবাহ- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বাংলা ১ম পত্র পিডিএফ

সুভা গল্পের mcq (সুভা গল্পের বহুনির্বাচনি প্রশ্ন